কক্সবাজার কারাগার: ‘দ্বিতীয় জামিন’ ছাড়া বন্দিদের মুক্তি মেলে না

মুহাম্মদ আবুল কাশেম, যুগান্তর :

কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দিদের ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। তবে জেল সুপার হিসাবে নেছারুল আলম যোগদানের পর দুর্নীতি-অনিয়ম সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

‘অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া কক্সবাজার কারাগার’-শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ১৬ ফ্রেরুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশ হওয়ার পর ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। যদিও প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুজন সুবেদারকে বদলি করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন নেছারুল আলম। তবে এখনো বন্ধ হয়নি কারাগারে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের লিজ নেওয়া মোবাইল ব্যবসা। চলছে কারাগারে বসে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলও।

অভিযোগ রয়েছে, আদালত কারাগারে থাকা আসামিদের জামিন দিলেও জেল সুপার নেছারুল আলমের কাছ থেকে সহজে মুক্তি মেলে না। আটকে রাখেন দাবিকৃত টাকা না পাওয়া পর্যন্ত। বিশেষ করে যাদের নামে একাধিক মামলা রয়েছে তাদের প্রত্যেককে দুই থেকে পাঁচ-সাত দিন পর্যন্ত আটকে রেখে টাকা আদায় করেন।

কারাগার থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া চকরিয়ার এক যুবলীগ নেতা বলেন, ‘কারাগারে যাওয়ার দুদিন পর আদালত আমার জামিন মঞ্জুর করেন। ওইদিন বিকালে কারাগারে জামিননামা পৌঁছালে কারা কর্তৃপক্ষ আমার আরও পাঁচ-সাতটি মামলার জামিনের ঝামেলা রয়েছে জানিয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে বাধ্য হয়ে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সন্ধ্যায় কারাগার থেকে বের হই।’

আমিন নামের এক উখিয়াবাসী বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় গত সপ্তাহে জামিন পান। আদালত থেকে জামিনের কাগজ পৌঁছে দুপুর ২টার দিকে। এরপর আমাকে বলা হয়, সন্ধ্যা নাগাদ বের হতে পারবেন। রাত ৮টার পরও বের না হওয়ায় একজন কারারক্ষীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কেউ আপনাকে কিছু বলেনি? আমি জানতে চাইলাম কি বিষয়ে। তিনি জানান, কারাগারে দ্বিতীয়বার জামিন নিতে হয়। না হলে চলে যান আপনাকে আসতে হবে না। কয়েকদিন পর আসামি নিজেই বাসায় পৌঁছে যাবে। পরে আবার জানান, টাকা না দিলে বের হওয়া যাবে না। আমি তাৎক্ষণিক ৫ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দিলে আধা ঘণ্টার মধ্যে বের হয়ে আসেন ওই আত্মীয়।’

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া নুরুল আলম, মো. সাদ্দামসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, যাদের একের অধিক মামলা আছে অথবা মাদকের মামলা রয়েছে, তারা জামিন পেলেও বের হতে পারেন না। টাকা না দিলে কারা কর্তৃপক্ষ জামিনের নানা ঝামেলা দেখিয়ে ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে। যারা টাকা দিতে রাজি হন না তাদের ২ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত আটকে রাখা হয়।

হাসপাতালের প্রতিবেদন বাণিজ্য : এ কারাগারে বন্দি থাকা মাদক মামলার আসামি কিংবা টাকাওয়ালা আসামিরা নিজকে অসুস্থ দেখিয়ে দ্রুত জামিনের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে আসামিদের কারা হাসপাতালের প্রতিবেদন নিতে হয়। আসামিপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে শারীরিক অবস্থা জানার জন্য কারা হাসপাতালের প্রতিবেদন চেয়ে পাঠান আদালত। প্রতিবেদন পক্ষে যাবে না বিপক্ষে যাবে তা নির্ভর করে টাকার অঙ্কের ওপর। অভিযোগ আছে, কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী লাখ টাকার বিনিময়ে ইয়াবা কারবারিদের গুরুতর অসুস্থ দেখিয়ে ও উন্নত চিকিৎসা জরুরি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এতে কারাবন্দি সাধারণ অসুস্থ রোগীরা বিপাকে পড়েন। সাধারণ বন্দিকে গুরুতর অসুস্থ সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন নিতে হলে জেল সুপারকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।

জানা যায়, এই টাকা সংগ্রহ করেন দুই কারারক্ষী কবির ও আছিম। দুজনই জেল সুপারের কাছের। দুজনই কারাগারের ভেতরে ও বাহিরের অপকর্ম দেখা শোনার দায়িত্বে রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। আছিম ও কবিরের আয়ের একমাত্র উৎস কারাগারের বিভিন্ন বাণিজ্য। তারা এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ নভেম্বরে এ কারাগারে জেল সুপার হিসাবে যোগদান করেন নেছারুল আলম। ৩০ নভেম্বের সন্ধ্যায় মোস্তাফা (২৫) নামের এক হাজতির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া হাজতি মোস্তফা কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়নের হরিপুর এলাকার বশির আহমেদের ছেলে। তবে, তারা এলাকায় ‘রোহিঙ্গা’ বলে পরিচিত।

জানা যায়, সদর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফুর রহমান আজাদকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা চেষ্টার সময় মোস্তফা হাতেনাতে ধরা পড়ে। ১৮ নভেম্বর পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় তাকে। এ মামলায় ২৯ নভেম্বর মোস্তফার ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে ৩০ নভেম্বর রহস্যজনকভাবে কারাগারে তার মৃত্যু হয়। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি মোস্তফা আত্মহত্যা করেছে। তবে অভিযোগ আছে-রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার আগে কোনো একটি পক্ষের ইন্ধনে জেল সুপারের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। ঘটনার রহস্য ফাঁস হওয়ার আগেই হয়তো তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

এদিকে এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধান কারারক্ষী আবু তাহের, সহকারী প্রধান কারারক্ষী ফখরুল ইসলাম ও কারারক্ষী বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা এবং কারারক্ষী জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে নিজের দায় এড়ান জেল সুপার নেছারুল আলম। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেল সুপার নেছারুল আলম।

জানা যায়, নেছারুল আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অনেক অভিযোগ রয়েছে। যার তদন্তও চলছে।